শামীম আল মামুন : ২০১৮ সালের ১২ই মার্চ নেপালের কাঠমান্ডু ত্রিভুবন বিমানবন্দরে বিধ্বস্ত হয় বাংলাদেশের ইউএস বাংলা এয়ারলাইন্সের একটি যাত্রীবাহী বিমান। বিমানের ক্যাপ্টেন আবিদ সুলতান ছিলেন ফ্লাইটের পাইলটের দায়িত্বে। তাঁর সঙ্গে কো-পাইলট হিসেবে ছিলেন পৃথুলা রশিদ। দুর্ঘটনায় তারা দু’জনসহ বিমানের মোট ৫১ জন যাত্রী এবং ক্রু নিহত হন। ২০ জন প্রাণে বেঁচে গেলেও তাদের অনেকের আঘাত ছিল গুরুতর। আঘাতের চিহ্ন নিয়ে তাদের মধ্যে বেচে থাকে টাঙ্গাইলের পৌর এলাকার ২নং ওয়ার্ডের এনায়েতপুর দক্ষিন পারায় সোনালী ব্যাংক কর্মকর্তা হুমায়ূন কবিরের মেয়ে ইমরানা কবির হাসি। রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত ছিলেন তিনি।
জানা যায়, গত বছর ১২মার্চ ইমরানা কবির হাসি ও তার স্বামী মো. রকিবুল হাসান নেপালে ঘুরতে যাওয়ার সময় ইউএস বাংলার একটি বিমান দূর্ঘটনার স্বীকার হন। সে সময় সেখানেই তার স্বামী রকিবুলের মৃত্যু হয় । ভাগ্যের জোরে বেচে যায় ইমরানা কবির হাসি। কিন্তু হাসি বেচে থেকেও যেনো তার সেই বিভীষিকা স্মৃতি নিয়ে চলছে।
তবে তিনি জানিয়েছেন যতদিন বেচে থাকবেন এই দুঃসহ স্মৃতি নিয়েই বেচে থাকবেন। দীর্ঘ ১১মাস পর শুধু বাবা-মায়ের সাথে দেখা করতে গত ৮ ফেব্রুয়ারি বাসায় আসে । আরও কয়েকটি অপারেশন বাকি আছে। এখনো চিকিৎসাধীন আছি ইউএস বাংলার অধীনে।
হাসির স্বামী রকিবুল হাসান সম্পর্কে জানানো হয় তিনি বেঁচে নেই। প্রকৌশলী রকিবুলের গ্রামের বাড়ি সিরাজগঞ্জের চৌহালী উপজেলার বাঘুটিয়া গ্রামে। তিনি রুয়েটের কম্পিউটার সায়েন্স বিভাগের জিরোসিক্স সিরিজের শিক্ষার্থী ছিলেন। রকিবুল ঢাকায় একটি বেসরকারি সফটওয়ার কোম্পানিতে চাকরি করতেন।
সোমবার (১১ মার্চ) দুপুরের টাঙ্গাইলের এনায়েতপুর দক্ষিণ পাড়ার বাড়িতে গিয়ে তারা বাবা, মা, ভাই, বোন ও হাসিকে পাওয়া যায়। সেদিনের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে অনেকেই অকোপটে কেঁদেছিলেন।
হুমায়ন কবির জানান, গত বছরের ১২মার্চ তার মেয়ে ও মেয়ের জামাই সাত দিনের ভ্রমণে ঢাকা বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর ইউএস বাংলা বিমান যোগে নেপালের উদ্দেশ্যে রওনা হয়। তাদের বিমানবন্দর পর্যন্ত পৌছে দেওয়ার পর সে বাড়ির দিকে রওনা হয়। ট্রেনে আসার সময় হাসির মামাতো ভাই তাকে ফোন করে জানতে চায় হাসি ও তার স্বামী নেপালের উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছে কিনা। হুমায়ন কবির রওনা হওয়া বিষয়টি নিশ্চিত করলে ওই মামাতো ভাই জানান তাদের বিমানটি দূর্ঘটনার স্বীকার হয়েছে।
খবরটি শোনার পর কিভাবে সে টাঙ্গাইল পৌছাইছে কিছুই বলতে পারবে না। টিভির খবরে হাসিকে এক নজর দেখার পর সে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলো। অপরদিকে দুর্ঘটনার স্বীকার যাত্রীদের আত্মীয়-স্বজনদের নেপালে নেওয়া হবে এমন সংবাদ পাওয়ার পর সে পূণরায় বিমানবন্দরের উদ্দেশ্যে রওনা হয়। রাত ১২টা সে ইউএস বাংলার অফিসে গিয়ে পৌছায়। তার পাসপোর্ট না থাকায় হাসির বান্ধবীর জামাইকে নেপালে পাঠায়। নেপাল থেকে হাসিকে সিঙ্গাপুর নেওয়া হবে এমন খবর পাওয়ার পর হুমায়ন কবির দ্রুত সময়ের মধ্যে পাসপোর্ট করে ১৫ মার্চ নেপাল গিয়ে পৌছায়।
নেপালের হাসপাতালে সর্বশরীরে ব্যান্ডেজ করা থাকায় নিজের মেয়েকে চিনতে পারছিলেন না তিনি। কম্পিউটারে মুখ দেখে তিনি নিশ্চিত হন। মেয়েকে আব্বু বলে ঢাকার পরও একটু ‘অ্যা’ বলে শব্দ ছাড়া আর কিছুই বলতে পারছিলেন না হাসি। তারপর সকাল বিকাল হাসপাতালে গেলেও হাসির সাথে কোন কথা বলতে পারেনি। শুধু মৃত দেহের মতো হাসিকে পড়ে থাকতে দেখেছে।
১৬ মার্চ ইউএস বাংলার কর্মকর্তা, বাংলাদেশের মেডিকেল টিমসহ উর্দ্ধতম কর্মকর্তারা হাসির বাবাকে নিয়ে বৈঠক করে হাসিতে সিঙ্গাপুরে স্থানান্তরের সিদ্ধান্ত নেয়। ১৭ তারিখ রাত ১২টা ফ্লাইডে সে ও তার মেয়ে হাসিকে সিঙ্গাপুর নেওয়া হয়। পরদিন সিঙ্গাপুরের হাসপাতালে হাসিকে ভর্তি করা হয়।
ভর্তি করার তিন ঘন্টা পর ডাক্তার হুমায়ন কবিরকে জানান হাসিকে বাচানো সম্ভব, তবে হাসির বাম হাতের কব্জি পর্যন্ত কেটে ফেলতে হবে। ওই হাসপাতালেই হাতের চিকিৎসক বাংলাদেশি ডাক্তারকে জানানো হয় তার দেশের রোগী আসছে। খবরটি শুনে তিনি ওয়ার্ডে আসেন। তিনি হাতের চিকিৎসাই করেন। হাতের ডাক্তার জানালেন কব্জি পর্যন্ত কাটতে হবে না হাতের পাঁচটি আঙ্গুল কাটতে হবে। পিতার অনুমতি পাওয়ার পর হাসির পাঁচটি আঙ্গুল কাটা হয়। সিঙ্গাপুরের চিকিৎসা অত্যাধুনিক ভাল থাকা ৯দিন চিকিৎসা নেওয়ার পর হাসি সুস্থ্য হয়।
হুমায়ন কবির বলেন, এত বড় দুর্ঘটনার পর আল্লাহর রহমতে আমার মেয়ে ফিরে আসবে, আমি কখনও কল্পনাও করি নাই। ইউএস বাংলা হাসির চিকিৎসার দায়ভার নেওয়ায় আমি তার চিকিৎসা করে সুস্থ্য করতে পেরেছি। এমন দুর্ঘটনা পৃথিবীতে আর যে না হয় সেই কামনা করছি। নেপাল ও সিঙ্গাপুরে হাসির কাছে বসে বসে কান্না করেছি ও দোয়া প্রার্থনা করেছি এমন বিপদ যেন আর কারো না হয়।
হাসির এক জায়গার চামড়া কেটে আরেক জায়গায় লাগানো হয়েছে। সে ব্যাথায় অনেক কান্না করেছে। এতো কষ্টের পরও হাসি বেচে থাকায় আল্লাহ তালার কাছে শুকরিয়া কামনা করি।
হাসি জানান, ১২মার্চ সবই কিছু স্বাভাবিক থাকায় দুপুরের দিকে তাদের বহনকৃত বিমানটি ফ্লাই করে। ঘন্টা খানেক যাওয়ার পরই একটি পাহাড় দেখে হাসি বোঝতে পারে তারা নেপাল পৌছে গিয়েছে। বিমানটি ল্যান্ড করবে এমন ভেবে হাসি ও তার স্বামী কথা বলতে ছিলেন ও ছবি তুলতে ছিলো। কিছুক্ষণ পর অস্বাভাবিক ঝাকুনি লেগে বিমানটি মাটিতে পড়ে যায়। অধিক ঝাকুনি লাগার পর হাসি বুঝতে পেরেছিলো বিমানটি স্বাভাবিকভাবে ল্যান্ড করেনি। তখন সে বুঝতে পারেনি বিমানটি দুর্ঘটনা কবলিত। ততক্ষণে তার স্বামী উল্টে পড়ে সিটের তলে গিয়েছে। তার ডান হাতে জোড়ে ধাক্কা লাগার ফলে সে হাত পা নাড়াতে পারছিলো না। যখনই হাত পা নাড়াতে পারছিলো না তখনই সে বুঝতে পারছিলো তার কিছু হয়েছে। তার স্বামীকে একাধিকবার ডাকার পরও কোন সারা শব্দ পাচ্ছিলো না। দুই এক মিনিটের মধ্যে তাদের কাছে আগুন আসেনি। কিন্তু বিমানটি দুই ভাগ হয়ে গিয়েছিলো। অনেকেই বের হচ্ছে। কিন্তু বাম হাত দিয়ে সিট বেলা খোলার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়। সিটবেলটি খুলতে পারলে হাসির ক্ষয়ক্ষতি কম হতো ও নিজের স্বামীর খবর নিতে পারতো। ততক্ষণে যে যার মতো বের হয়ে যাচ্ছে।
হাসি ভাবতেছিলো বিমান দুর্ঘটনায় কেউ বাচে, সেউ হয়তো বাচবে না। মারা যাবে ভেবে কালেমা পড়তেছিলো হাসি। তার সামনেও এক মহিলা কালেমা পড়তেছিলো। সামনের ওই মহিলা বেচে থাকলে ও হাসি মারা গেলে তার বাবা মাকে খবর দিতে বলে। পিছন থেকে ভয়াবহ আগুন আসতেছিলো। বিমানে যারাছিলো তারাও আগুনে পুড়তে লাগলো। ততক্ষণে হাসির পিঠে, মাথায়, চুলে এবং হাতেও আগুন ধরেছিলো। আগুনে পুরতে থাকায় নিরুপায় হয়ে তার স্বামীকে ডাকতে লাগলো। কিন্তু তখনও কথা বলছিলো না স্বামী মো. রকিবুল হাসান। প্রচন্ড আগুন ও অধিক পরিমাণে ধোয়া থাকায় মুখে সামনে ওড়না নিয়ে নিশ্বাস নিচ্ছিলেন তিনি। কতক্ষণ আগুনে পুড়েছে সেটাও বলতে পারেনি হাসি।
তিনি আরও জানান, কিছুক্ষণ পর পানির মতো কিছু বিমানে দেওয়া হয়েছিলো, কিন্তু তাও আগুন নিয়ন্ত্রণে আসেনি। তার ফোমের মতো কিছু দেওয়ায় বিমানের আগুন ও তার গায়ের আগুন নিভে যায়। তখন তিনি বুঝতে পেরেছিলেন কেউ একজন তার পাশে আছে। সেভ মি, সেভ মি বলে ডাকার পর ফায়ার সার্ভিস অথবা সেনাবাহিনীর কেউ এসে তাকে উদ্ধার করে। সামনে থাকা মহিলা ও তার স্বামী এবং তাকে সেভ করতে বলেন। তার হাত ভাঙ্গা থাকায় খুব যত্মে তাকে অ্যাম্বুলেন্সে তোলে। তিনি মারা যাবেন এমনটাই ভাবছিলেন। খাবারের পানি চাচ্ছিলেন। কেউ তার মুখে পানি দিয়েছিলো কিনা তার খেয়াল নাই। তার পর কি হয়েছিলো সেই কিছুই বলতে পারেনি।
৯ দিন পর তার জ্ঞান ফিরে। নেপালে ছয়দিন ও সিঙ্গাপুরে তিনদিন কিভাবে কাটছে সেই কিছুই বলতে পারেনি। একের পর এক অপারেশন, ড্রেসিংতো আছেই। একদিন পর পর দুই-তিন ঘন্টা ড্রেসিং ছিলো খুবই ভয়াবহ। জ্ঞান ফিরার পর স্বামীর কথা জানতে চাইলে নেপালে আছে বলে জানায় তার বাবা। সে তার স্মামীর কাছে যাওয়ার চেষ্টা করেছে একাধিকবার, কিন্তু কেউ তাকে নিয়ে যায়নি। আড়াই মাস চিকিৎসা নেওয়ার পর দেশে ও ১১ মাস পর বাড়িতে ফিরেছেন তিনি। এখনও আরও কিছু চিকিৎসা বাকি আছে তার।
ইমরানা কবির হাসি বলেন, দুর্ঘটনা তো দুর্ঘটনাই। সেটি যেকোন মুহুর্তে হতে পারে। আল্লাহর রহমতে মানুষের দোয়ায় ও বাংলাদেশ সরকার এবং ইউএস বাংলার সার্বিক সহযোগিতায় সিঙ্গাপুরে চিকিৎসা হয়েছে বিধায় আমি এখনো সুস্থ্য আছি। আমার পিছনের দুই মেয়ে, আমার সামনের একজনসহ অনেকেই চোখের সামনে মারা গেছে। ওই অবস্থায় আমারও বাচার কথা ছিলো না। আল্লাহ পাক চাইছেন বলে আমি বেচে আছি।
আইসিইউতে চিকিৎসা নেওয়া অবস্থায়ও আমার চোখে আগুন ভাসতো। শারিরীক ট্রিটমেন্ট সবাই করতে পারে, কিন্তু মানসিক ট্রিটমেন্ট কেউ করতে পারে না। পুরোপুরি সুস্থ্য হয়ে রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক হিসেবে পূণরায় দায়িত্ব পালন করতে চাই। সেখানে সহকর্মী ও শিক্ষার্থীদের সাথে থেকে শারিরীক ও মানসিক দুদিক থেকে সুস্থ্য থাকতে চাই।
Discussion about this post