কারকনিউজ ডেস্ক : জালিয়াতির ৩৩টি মামলায় ভুল আসামি হয়ে টাঙ্গাইলের জাহালমের তিন বছর কারাভোগ করার ঘটনায় দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) দায় কতটুকু, তা আদালত নির্ণয় করবেন বলে মন্তব্য করেছেন তাদের আইনজীবী খুরশীদ আলম খান।
দুদকের আইনজীবীর মতে, ব্যাংকগুলোর দেওয়া কাগজপত্রের ভিত্তিতে অভিযোগপত্র দিয়েছিলো। কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও সোনালী ব্যাংকের দেওয়া তথ্য-উপাত্ত আমলে না নেওয়ার এখতিয়ারও দুদকের নেই।
এ বিষয়ে ঘটনার একটি হলফনামা মঙ্গলবার (৫ মার্চ) হাইকোর্টে জমা দিয়েছে দুদক। বুধবার (৬ মার্চ) আদালতের একটি দ্বৈত বেঞ্চে উপস্থাপন করা হবে।
দুর্নীতি দমন কমিশন আইন, ২০০৪ এর ৩১ ধারায় বলা হয়েছে, ‘এই আইন বা তদ্ধীন প্রণীত বিধি বা আদেশের অধীন দায়িত্ব পালনকালে সরল বিশ্বাসে কৃত কোনো কাজের ফলে কোনো ব্যক্তি ক্ষতিগ্রস্ত হলে বা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকলে, সেজন্য কমিশন, কোনো কমিশনার অথবা কমিশনের কোনো কর্মকর্তা বা কর্মচারীর বিরুদ্ধে দেওয়ানি বা ফৌজদারি মামলা বা অন্য কোনো আইনগত কার্যধারা নেওয়া যাবে না।’ জাহালমের জামিন আদেশের পর গত ৩ ফেব্রুয়ারি দুদকের আইনজীবী জাহালমের ঘটনার বিষয়ে ব্যাখ্যা দাখিলের জন্য সময় দেন হাইকোর্ট।
দুদক আইনজীবী খুরশীদ আলম খান সাংবাদিকদের বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক ও সোনালী ব্যাংকের অনুসন্ধান প্রতিবেদনের তথ্য-উপাত্তের উপর ভিত্তি করে দুর্নীতি দমন কমিশন প্রথম অভিযোগপত্র দেয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের মতো একটি কেন্দ্রীয় ব্যাংক এবং সোনালী ব্যাংকের মতো একটি সরকারি ব্যাংক যখন আমাকে কিছু তথ্য-উপাত্ত পাঠাবে অবশ্যই সেটা আমাকে আমলে নিতে হবে। সেটার ভেলিডিটি (বৈধতা) নিয়ে প্রশ্ন ওঠানো দুদকের কোনো আইনগত এখতিয়ার নেই।
তিনি বলেন, ব্যাংকের মাধ্যমেই তথ্য-উপাত্ত পেয়ে আমরা অভিযোগপত্র দাখিল করেছি। ব্যাংকের অফিসিয়ালসরাই তাকে (জাহালমকে) আইডেন্টিফাই করেছে। আমরা সে কথাগুলো এফিডেবিট ইন ফ্যাক্টসে (ঘটনার বর্ণনা বা ব্যাখ্যা হলফনামা আকারে দাখিল) দাখিল করেছি। আশা করি কাল শুনানি হবে।
দুদক আইনজীবী বলেন, তার আগে ব্যাংকগুলোকে পক্ষভূক্ত করতে যে আবেদন, সেটি আগে শুনানি করতে চাইছি। কারণ এখানে ব্যাংক খুবই গুরুত্বপূর্ণ পারসন। আমরা চাই ব্যাংকগুলো এসে তাদের কথা বলুক।
এ ঘটনায় দুদকের দায় নিয়েছে কিনা? এমন প্রশ্নে খুরশীদ আলম খান বলেন, বিচারাধীন বিষয়ে মন্তব্য করা ঠিক না। আপনারা যেহেতু জিজ্ঞেস করছেন তাই বলছি, এ ঘটনায় দুদকের দায় কতটুকু, কিংবা অমার দায় আদৌ আছে কিনা সেটা আদালত নির্ণয় করবেন। কারণ আমি পাবলিক ডকুমেন্টের ভিত্তিতে সরল বিশ্বাসে কাজ করেছি। সে বিষয়ে দুর্নীতি দমন কমিশন আইনের ৩১ ধারায় বলা আছে। সেখানে বলা হয়েছে, আমি যদি সরল বিশ্বাসে কাজ করে থাকি তাহলে দায়মুক্তি পাওয়া যাবে। এখানে আমার দায় কতটুকু সেটা নির্ণয় করবেন আদালত। এই কারণে আদালতকে আমরা বলেছি, এই ব্যাংকগুলোকে পক্ষভূক্ত করে ব্যাংকসহ আমাদের কথা একই সঙ্গে শোনেন।
তাহলে কি জাহালমের ঘটনায় দুদক দায়মুক্তির পথ খুঁজছে কিনা? জবাবে তিনি বলেন, অবশ্যই না, অবশ্যই না। আদালত যে আদেশ দিয়েছেন সে আদেশটা আমরা পালন করছি।
জাহালমের ঘটনায় দুদকের ব্যাখ্যার বিষয়ে খুরশীদ আলম খান বলেন, জাহালম বিষয়ে একটি হলফনামা দেওয়ার জন্য আগামীকাল তারিখ ধার্য আছে। আজকে হলফনামাটা তৈরি করে আদালতের অনুমতি নিয়েছি, আদালত হলফনামার জন্য অনুমতি দিয়েছে। এখন হলফনামার কাজ চলছে, ১৩০ পাতার মতো। আমরা যেসব ডকুমেন্টের বেসিসে ইনভেস্টিগেশন রিপোর্ট দিয়েছি, সবকিছু এখানে আমরা দাখিল করেছি। খুব তাড়াহুড়া করেছি, কারণ সময় কম ছিল। আমরা আরও দেবো। আপাতত মোটামুটি যেটা দেওয়ার মতো গুরুত্বপূর্ণ কাগজগুলো আমরা দিয়েছি।
তিনি বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক, সোনালী ব্যাংকের রিপোর্টসহ যেসব রিপোর্টের ভিত্তিতে দুর্নীতি দমন কমিশন অভিযোগপত্র দায়ের করেছে, তার সবকিছু দেওয়া হয়েছে। দুর্নীতি দমন কমিশন জেলা জজ পদ মর্যাদার একজনকে দিয়ে অনুসন্ধান করিয়েছে, তার কপিও দেওয়া হয়েছে। ব্যাংক পক্ষভূক্ত করারও বিষয়ে খুরশীদ আলম খান বলেন, গতকাল (সোমবার) আমরা অনুমতি নিয়ে আরেকটা দরখাস্ত দাখিল করেছি পক্ষভূক্ত হওয়ার জন্য। কারণ বাংলাদেশ ব্যাংক তাদের প্রতিবেদনে বলেছে ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে মিস ম্যানেজমেন্ট হয়েছে। সোনালী ব্যাংকও বলেছে এই কথা। সেজন্য আমরা বাংলাদেশ ব্যাংক, সোনালী ব্যাংক, সিটি ব্যাংক লিমিটেড, ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক, ব্র্যাক ব্যাংককে পক্ষভূক্ত করার জন্য একটা দরখাস্ত দিয়েছি। আশা করছি কাল শুনানি হবে। আদালতকে আমরা বলেছি কেন তাদের পক্ষভূক্ত করা প্রয়োজন। মোট ১৮টি ব্যাংক এখানে ইনভলব। কিন্তু আমরা আপাতত পাঁচটিকে করেছি। এই পাঁচটাকে করলেই আমরা মনে করি সত্য ঘটনাটা বের হয়ে আসবে।
প্রসঙ্গত, সোনালী ব্যাংকের সাড়ে ১৮ কোটি টাকা জালিয়াতির অভিযোগে আবু সালেক নামে এক ব্যক্তির বিরুদ্ধে ৩৩টি মামলা দায়ের করে দুদক। এই অভিযোগে দুদক কার্যালয়ে হাজির হওয়ার কথা জানিয়ে চিঠি যায় জাহালমের টাঙ্গাইলের বাড়ির ঠিকানায়। চিঠি পেয়ে প্রায় পাঁচ বছর আগে দুদক কার্যালয়ে হাজির হয়ে জাহালম জানান, তিনি মামলার আসামি সালেক নন, তার নাম জাহালম। এ সময় জাহালম নিজেকে নির্দোষ দাবি করেন। তবে সেদিন নিরীহ পাটকল শ্রমিক জাহালমের কথা কেউ বিশ্বাস করেননি। দুদকের ভুলে ২০১৬ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি আসামি সালেকের বদলে গ্রেফতার হন জাহালম। এরপর দুদকের এসব মামলায় সালেকের বদলে জাহালমকে তিন বছর কারাগারে থাকতে হয়। কারাবন্দি জাহালম অনেকবার আদালতে হাজিরা দিলেও জামিন মেলেনি।
এদিকে, দুদকের দায়ের করা ৩৩টি মামলার মধ্যে ২৬টি মামলায় জাহালমকে আসামি আবু সালেক হিসেবে চিহ্নিত করে অভিযোগপত্র দেয় দুদক। এসব মামলায় বিচারিক আদালতে বিচারও শুরু হয়।
দুদকের মামলায় প্রকৃত আসামি আবু সালেকের বদলে নির্দোষ শ্রমিক জাহালম কারাগারে বন্দি থাকার বিষয়টি গত ৩০ জানুয়ারি বিচারপতি এফ আর এম নাজমুল আহসান ও বিচারপতি কামরুল কাদেরের হাইকোর্ট বেঞ্চের নজরে আনা হয়। আদালত স্বপ্রণোদিত হয়ে রুল জারি করেন। এরপর ৩ ফেব্রুয়ারি জাহালমকে দুদকের ২৬টি মামলা থেকে অব্যাহতির আদেশ দেন। ওই রাতেই কারাগার থেকে মুক্তি পান জাহালম ওরফে জানে আলম।
Discussion about this post