বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর পেরিয়ে গেছে দীর্ঘ ৪৭টি বছর। ১৯৭১ সালের ৯ মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের ফসল এই স্বাধীন বাংলাদেশ। ৩০ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে বীর বাঙালি পেয়েছে লাল-সবুজের স্বাধীন পতাকা। সম্ভ্রম হারিয়েছেন দু’লক্ষাধিক মা-বোন। আর কত মানুষ যে আহত হয়েছেন, পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন তার কোনো হিসেব নেই।যারা দেশের জন্য জীবন দিয়েছেন, সর্বস্ব হারিয়েছেন এ জাতি তাদের শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে। তবে এমনও অনেকে আছেন যারা পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী কর্তৃক নির্মম গণহত্যার শিকার হয়েছেন অথচ কেউ তাদের মনে রাখেনি। মনে রাখার চেষ্টাও করেনি। সবাই তাদের বেমালুম ভুলে আছেন।
শুধু তাই নয়, গণহত্যা হিসেবে স্বীকৃতিটুকুও মিলেনি তাদের ভাগ্যে।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে বর্বর পাকিস্তানি হানাদারেরা দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে নারকীয় হত্যাযজ্ঞ চালায়। পাখির মতো গুলি করে হত্যা করে এদেশের অগণিত নিরপরাধ আবাল-বৃদ্ধ-বনিতাকে। এমনই এক নির্মম গণহত্যার ঘটনা ঘটে টাঙ্গাইলের কালিহাতী উপজেলার নারান্দিয়া ইউনিয়নের পালিমা গ্রামে।
সেখানে একদিনে গুলি করে ও আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করা হয় পিতা-পুত্রসহ পালিমা গ্রামের ১৭ জন নিরপরাধ মানুষকে। গুলিবিদ্ধ হয়ে কিছুদিন পর ধুকে ধুকে মারা যান আরো তিনজন। এ ঘটনায় সবমিলিয়ে শহীদ হন ২০ জন। আগুনে জালিয়ে দেয়া হয় অর্ধশতাধিক ঘরবাড়ি। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বিভিন্ন অঞ্চলে গণহত্যার ঘটনার সন্ধান মেলে।
কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে পালিমার গণহত্যার ঘটনাটি এখনো সবার চোখের আড়ালেই রয়ে গেছে। ইতিহাসের পাতায় এতটুকু স্থান হয়নি হৃদয় কাঁপানো নির্মম এ হত্যাযজ্ঞের। শহীদ পরিবারের সদস্যরাও সরকারিভাবে কখনো কোনো সাহায্য-সহযোগিতা পাননি।
সরেজমিনে গিয়ে পালিমা গ্রামের লোকজনের সাথে কথা বলে সেদিনের লোমহর্ষক ঘটনার বিবরণ জানা যায়।
টাঙ্গাইল-ভূঞাপুর সড়কটি গিয়েছে পালিমা গ্রামের একেবারে বুকের ওপর দিয়ে। টাঙ্গাইল থেকে ভূঞাপুরের দিকে যাওয়ার জন্য তখন থেকে এখন অবধি এটাই প্রধান রাস্তা। এছাড়া গ্রামের মাঝখান দিয়ে পূর্ব-পশ্চিমে বয়ে গেছে পোষণা নদী। চারদিকে যুদ্ধ চলছিল। এরই মধ্যে ১৯৭১ সালের ৮ আগস্ট রোববার খুব ভোরবেলায় কয়েকটি গাড়িতে করে পাকিস্তানি হানাদারেরা টাঙ্গাইলের দিক থেকে পালিমা গ্রামে প্রবেশ করে।
পালিমা ব্রিজের ঠিক আগে মুক্তিযোদ্ধাদের বাধার মুখে পড়ে তারা। পোষণা নদীর উত্তরপাশের বাড়িগুলোতে মুক্তিযোদ্ধারা অবস্থান নিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। শুরু হয় উভয়পক্ষের মধ্যে গোলাগুলি। কিন্তু হানাদারদের ভারী অস্ত্রের সামনে টিকতে না পেরে একপর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধারা পিছু হটে।
তখন হানাদারেরা সড়ক থেকে নেমে ক্ষেপাটে হায়েনার মতো পালিমা গ্রামের ভিতরে ঢুকে গণহত্যা শুরু করে। তারা যাকেই সামনে পেয়েছে তাকেই গুলি করে নির্মমভাবে হত্যা করেছে। আগুন দিয়ে জালিয়ে দিয়েছে অর্ধশতাধিক ঘরবাড়ি। কাউকে আবার ঘরে আটকে রেখে সেই ঘরে আগুন দিয়ে পুড়িয়েও হত্যা করে। সবমিলিয়ে সেদিনের ঘটনায় ২০ জনের প্রাণহানি ঘটে।
সেই নারকীয় গণহত্যায় যারা প্রাণ হারিয়েছেন তারা হলেন, পালিমা দক্ষিণপাড়ার রহিম উদ্দিনের ছেলে আব্দুল মিয়া, আয়েন উদ্দিনের ছেলে মফেজ উদ্দিন, আহাদি শেখের ছেলে ময়েজ উদ্দিন, গাজী ম-লের ছেলে জাবেদ আলী, ঘুতু শেখের ছেলে পচা ম-ল, পালিমা গ্রামের ঘরজামাই হাছেন আলী (তিনি এলেঙ্গা-পাথাইলকান্দি গ্রামের মিয়াজানের ছেলে), পালিমা পালপাড়ার পচা শেখের ছেলে তরু শেখ ও তরু শেখের ছেলে ময়েন উদ্দিন, আনন্দ পালের ছেলে গেন্দা পাল ও সহদেব পালের ছেলে মদন পাল, পালিমা সিমাকাছরার অনুউল্লাহ সরকারের ছেলে আব্দুল হালিম, রইক্কা মুন্সির ছেলে মোসলেম উদ্দিন, টেনা আফছারের ছেলে হযরত আলী, ময়ন উদ্দিনের ছেলে আফাজ উদ্দিন, পালিমা মোড়সংলগ্ন জোনাব আলীর ছেলে ঝরু শেখ ও ইন্তাজ আলীর ছেলে হযরত আলী হজু এবং পালিমা উত্তরপাড়ার কছর শেখের ছেলে রিয়াজ উদ্দিন।
এই ১৭ জনকে একদিনেই গুলি করে হত্যা করে বর্বর হানাদার বাহিনী। এছাড়া গুলিবিদ্ধ হয়ে কিছুদিন ধুকে ধুকে অবশেষে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন আরো তিনজন। তারা হলেন পালিমা দক্ষিণপাড়ার নছু শেখের ছেলে সায়েদ আলী, ঘুতু শেখের ছেলে আছান আলী ও গণহত্যার দিনে প্রাণ হারানো হাছেন আলীর স্ত্রী ফালানী বেগম।
সেদিন পালিমার প্রতিরোধ যুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী কাদেরিয়া বাহিনীর কোম্পানী কমান্ডার খোরশেদ আলম তালুকদার বীরপ্রতীকের সাথে কথা হলে তিনি ঘটনার বিবরণ দেন এভাবে, ‘আমরা ১৯৭১ সালের ৭ আগস্ট শনিবার ভোরে কালিহাতী উপজেলার শোলাকুড়া ব্রিজ ধ্বংস করে পালিমা ব্রিজের উত্তরপাশে জসিম উদ্দিনের বাড়িসহ আশেপাশের কয়েকটি বাড়িতে অবস্থান নেই। আমার সাথে ১০০ জনের মতো মুক্তিযোদ্ধা ছিল। ধারণা ছিল শোলাকুড়া ব্রিজ ভাঙার খবর পেয়ে হানাদারেরা পালিমার দিকে আসতে পারে। তাই বলে এত ভোরবেলায় আসবে তা ধারণা করিনি। যে কারণে আমাদের প্রস্তুতিও ছিল না তেমন। কোনো রাজাকারের মাধ্যমে হানাদারেরা আমাদের অবস্থান সম্পর্কে নিশ্চিত হয়। পরদিন ৮ আগস্ট রোববার খুব ভোরে আমরা কিছু বুঝে উঠার আগেই হানাদারেরা পালিমা ব্রিজের দক্ষিণপাশ থেকে আমাদের লক্ষ্য করে গুলি করে। আমরাও পাল্টা গুলি করি। এক ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে চলে গোলাগুলি। গুলির ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে যায় পুরো এলাকা। একপর্যায়ে আমরা হানাদারদের ভারী অস্ত্রের সামনে কুলিয়ে উঠতে না পেরে পিছিয়ে আসি। তখন তারা গ্রামের ভিতরে ঢুকে এই হত্যাযজ্ঞ চালায়।’
গণহত্যায় নিহত পালিমা পালপাড়ার তরু শেখের ছেলে আমান আলী শেখ (৬৫) বলেন, ‘সেদিন ছিলো রোববার। খুব ভোরবেলায় গোলাগুলির শব্দ শুইনা ঘুম ভাঙে। আমাগো পাড়ার সবাই ভয় পাইয়া যে যার মতো পালাইতে থাকে। আমরাও বাড়ির পাশে নদীর কাছারে গিয়া পালাই। আমার বাবা ও বড় ভাই ছিল আমার থেকে একটু দূরে। আমি জঙ্গলের ভিতর থেকে সব দেখছিলাম। এক রাজাকারের সাথে একজন বিহারী এসে প্রথমে আমার বড়ভাই ময়েন উদ্দিনকে দাঁড় করাইয়া বুকে গুলি কইরা ফালাইয়া দেয়। তখন আমার বাবা জীবন ভিক্ষা চাইছিল। কিন্তু ওরা শুনে নাই। আমার চোখের সামনেই ওরা আমার বাবার বুকের ডান পাশে গুলি কইরা মাইরা ফালায়।’
এই কথাগুলো বলতে বলতে হঠাৎ থেমে যান আমান আলী। কষ্টে বারবার বুক চেপে ধরছিলেন তিনি। সেদিনের সেই ভয়ঙ্কর ও দুঃসহস্মৃতি যেন তাকে ঘিরে ধরে। নিজের চোখের সামনে বাবা ও ভাইয়ের করুণ মৃত্যুর কথা বলতে বলতে তিনি একসময় কেঁদে ফেলেন। চোখ মুছতে মুছতে আমান আলী বলেন, ‘বিহারীরা চইলা যাওয়ার পর আমার বাবা ও ভাইয়ের রক্তভেজা লাশ আইনা বাড়ির পাশে কবর দেই। সেদিনের কথা মনে হইলে অন্তরডা ফাইটা যায়।’
পালিমা পালপাড়ার শহীদ গেন্দা পালের ভাতিজা ও শহীদ মদন পালের চাচা মনিন্দ্র পাল (৮০) বলেন, ‘সেদিন ভোরবেলায় গুলির শব্দ পাইয়া ঘুম থেইকা জাইগা উঠি। প্রাণের ভয়ে সবাই বাড়ির পাশের নদীর কাছে গিয়া পালাই। কেউ কেউ নদী সাঁতরে ওপার চইলা যায়। গেন্দা কাকাও ছিল আমাদের সঙ্গে। গেন্দা কাকা ঘরে রাইখা যাওয়া টাকা নিতে আইসা বিহারীগো হাতে ধরা পড়ে। সঙ্গে সঙ্গে বিহারীরা তাকে গুলি কইরা মাইরা ফালায়। আর আমার ভাতিজা মদন পাল ভোরে ঘুম থেইকা উইঠা প্রস্রাব করতে বাইরে আসামাত্রই বিহারীদের সামনে পড়ে। সঙ্গে সঙ্গে ওকেও গুলি কইরা মাইরা ফালায়। তারপর বিহারীরা চইলা গেলে আমরা আইসা লাশ দুইটাকে পোষণা নদীতে ভাসাইয়া দেই।’
পালিমা দক্ষিণপাড়ার শহীদ আব্দুল মিয়ার চাচাতো ভাই আমির আলী (৮০) বলেন, ‘আমি সেদিন ভোরবেলা জাল বুনাইতেছিলাম। হঠাৎ গুলির শব্দ শুনি। উঁকি দিয়া দেহি মিলিটারি। তখন সবাই যে যার মতো পাড়ার পূর্বদিকে পালাইয়া যাই। হত্যা কইরা মিলিটারিরা চইলা যায়। আমরা বেলা ১০/১১টার দিরে দিকে আইসা দেহি গুলি খাইয়া মইরা একেকজন একেক জায়গায় পইড়া আছে। কারো লাশ ধানক্ষেতে, কারো লাশ বাড়ির উঠানে। বিকেলে মুক্তিবাহিনীরা কাফনের কাপড় আইনা দিলে তা দিয়া যার যার বাড়ির পালানে লাশগুলো দাফন করি। তহন গোরস্থান ছিল না।’ শহীদ আব্দুল মিয়াকে ঘরে আটকিয়ে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে মারা হয় বলে তিনি জানান।
সেদিন গুলিবিদ্ধ হয়ে দুঃসহ জীবন নিয়ে এখনো বেঁচে আছেন কেউ কেউ। এমনি একজন হলেন পালিমা দক্ষিণপাড়ার মৃত কালু মিয়ার স্ত্রী ছালেহা বেগম। তার বাম হাতের কব্জিতে এবং বাম পায়ের হাঁটুর ওপরে গুলি লাগে। তখন থেকেই তার বাম হাতটি অকেজো হয়ে আছে। আমির আলীর সাথে কথা বলার সময় ছালেহা বেগম (৮০) ছুটে আসেন।
তিনি তার অকেজো হাতটি দেখিয়ে কষ্টের সাথে সেদিনের ঘটনা বর্ণনা করেন। একইসাথে তিনি সরকারি সহযোগিতা পাওয়ার দাবি জানান।
Discussion about this post