কারকনিউজ ডেস্ক : আলোচিত রিফাত শরীফ হত্যার এক মাসের বেশি সময় পার হলেও এখনো গ্রেপ্তার হয়নি মামলার এজাহারভুক্ত গুরুত্বপূর্ণ চার আসামি। এখন মামলার চার্জশিট দেয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে পুলিশ। প্রধান সাক্ষী মিন্নিকে গ্রেপ্তারের পর পুলিশের উৎসাহী ভূমিকা এবং তড়িঘড়ি করে চার্জশিট দেয়ার প্রস্তুতির বিষয়টি জনমনে নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে।
বাদী না হয়ে সাক্ষী, পরে আসামি:
দায়ের কোপে রিফাত শরীফ জখম হওয়ার পর বরগুনা হাসপতালে নিয়ে যান স্ত্রী মিন্নি। খবর পেয়ে ছুটে আসেন মিন্নির বাবা মোজাম্মেল হোসেন কিশোর। কিন্ত রিফাতের বন্ধুরা এ দুজনকেই হাসপাতাল ত্যাগ করতে এক প্রকার বাধ্য করেন। ফলে রিফাতের মৃত্যুর সময়ও পাশে থাকতে পারেননি মিন্নি ও তার পরিবারের সদস্যরা। ঘটনার পরের দিন মিন্নি ও পরিবারের সদস্যদের সাথে আলোচনা না করেই রিফাতের বাবা বরগুনা থানায় হত্যা মামলা দায়ের করেন। এতে প্রধান সাক্ষী রাখা হয় আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নিকে।
পরবর্তী সময়ে মিন্নির বিরুদ্ধে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নানা ধরনের প্রচার চলে, এক পর্যায়ে রিফাতের বাবা দুলাল শরিফ মিন্নিকে গ্রেপ্তারের দাবিতে সংবাদ সম্মেলন ও মানববন্ধন করেন। এসব কর্মসূচিতে সংসদ সদস্য ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভুর ছেলে সুনাম দেবনাথ অংশ নেয়ায় জনমনে সন্দেহ দেখা দেয়, কারণ, সুনামের বিরুদ্ধে মাদক ব্যবসার দুর্নাম রয়েছে।
মিন্নিকে গ্রেপ্তার পুলিশের অতি উৎসাহ :
মিন্নিকে গ্রেপ্তারের দাবিতে দুলাল শরীফের মানববন্ধনের পরদিন ১৬ জুলাই সকালে বাসা থেকে মিন্নিকে ডেকে পুলিশ লাইন্সে নিয়ে আসা হয়। টানা ১৩ ঘন্টা জিজ্ঞাসাবাদের পর রাত ন’টায় মিন্নিকে গ্রেপ্তার দেখায় পুলিশ। মিন্নির গ্রেপ্তার নিয়ে সংবাদ সম্মেলনে পুলিশ সুপার মারুফ হোসেন বলেন, ‘ব্যক্তিগত জিঘাংসার জায়গা থেকে রিফাত হত্যার ঘটনা ঘটেছে। এ ঘটনায় মাদকের কোনোরকম সংশ্লিষ্টতা নেই।’
১৮ জুলাই রিশান ফরাজী গ্রেপ্তার হওয়ার পর সংবাদ সম্মেলনে ফের পুলিশ সুপার বলেন, ‘হত্যার সাথে জড়িত থাকার কথা মিন্নি স্বীকার করেছে বলেই আমরা তাকে আদালতে হাজির করেছি। ঘটনার আগে ও পরে তিনি একাধিকবার অন্য আসামিদের সাথে মোবাইলে ফোনে কথা বলেছেন।’
মিন্নিকে গ্রেপ্তারের পর রিমান্ডের তথ্য গণমাধ্যমে চলে আসলেও অন্য আসামিদের জবানবন্দির ব্যাপারে কঠোর গোপনীয়তা বজায় রেখেছে পুলিশ। মামলার অন্যতম আসামি রিফাত ও রিশান ফরাজীর জবানবন্দির কোন তথ্য অনেক চেষ্টা করেও জানা যায়নি।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অপপ্রচার :
মিন্নিকে গ্রেপ্তারের আগে বেশ কিছুদিন ধরে মামলার অন্য আসামিদের ঘনিষ্ঠরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অপপ্রচার চালাতে থাকে। একটি পর্নো ভিডিওকে নয়ন ও মিন্নির বলে চালিয়ে দেয়া হয়। অবশ্য গত মঙ্গলবার প্রতিবেদককে নয়ন বন্ডের মা নিশ্চিত করে, ওই ভিডিওটি নয়ন বা মিন্নির নয়।
আড়ালেই থাকছে মাদকের সাম্রাজ্য ও এর হোতারা :
রিফাত শরীফ হত্যার পর সবচেয়ে বেশি আলোচিত বিষয়টি ছিল বরগুনায় মাদকের সাম্রাজ্য। বিভিন্ন গণমাধ্যমে এ নিয়ে একাধিক প্রতিবেদন প্রকাশ ও নাগরিকদের পক্ষ থেকে ঘটনার নেপথ্যে মাদক জড়িত দাবি করা হলেও পুলিশ সুপার বিষয়টি এড়িয়েই চলছেন- এমনটাই মনে করছেন বরগুনার সচেতন মহল। ১১ মে রাতে রিফাতকে ইয়াবাসহ গ্রেপ্তার করে পুলিশ। ওইসময় ঘটনাস্থলে উপস্থিত থেকে নয়ন বন্ড ঘটনার ভিডিও করে ছড়িয়ে দিয়েছিল। ওই ভিডিওতে নয়নকে বলতে শোনা যায়, ‘তুই আমার বাসায় ৮ বার ডিবি পাঠাইছিস, এখন নিজেই কট।’ ঘটনার দিন সকালে এই প্রতিবেককে নয়ন বন্ড বলেন, ‘ভাইয়া, রিফাত আমার বাসায় ১০ বার ডিবি পাঠিয়ে হয়রানি করছে, ও নিজে ব্যবসা করে আর আমারে ফাঁসাতে চায়’। নয়ন ও রিফাত শরীফের সবশেষ ঝামেলা শুরু হয়েছিল হেলালের কাছে রিফাত শরীফ মোবাইল ফোন কেড়ে নেয়ার পর, সেটাও যে মাদক বিক্রির টাকা পাওয়ার জেরেই- এমনটা একাধিক সূত্র জানায়।
বরগুনা নাগরিক পলিসি ফোরামের সভাপতি হাসানুর রহমান ঝন্টু এ বিষয়ে বলেন, ‘ হত্যার মুল কারণ নয়নের সাথে মিন্নির অনৈতিক সম্পর্ক- এটি প্রমানে তদন্তকারীরা মরিয়া। অথচ, এর নেপথ্যে মাদকের ভয়াল সাম্রাজ্য উদঘাটন হলেও সেটিকে আমলেই নিচ্ছে না পুলিশ।’
বরগুনা জেলা নাগরিক অধিকার সংরক্ষণ কমিটির সাধারণ সম্পাদক মনির হোসেন কামাল বলেন, ‘রিফাত হত্যার পেছনে মাদক অন্যতম কারণ, এটা নিশ্চিত। কিন্ত বিষয়টি এড়িয়ে যাচ্ছে পুলিশ।’
বাদী কেন চুপচাপ?
মামলার বাদি দুলাল শরীফ মিন্নিকে গ্রেপ্তারের দাবিতে সরব ছিলেন। এজাহারভূক্ত চার আসামি এখন পর্যন্ত গ্রেপ্তার না হওয়ার বিষয়টি নিয়ে তাঁর তেমন কোনো উচ্চবাচ্য নেই। রিফাতের বাবার এমন একপেশে ভূমিকা কেন- এমন প্রশ্ন অনেকের মনে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে রিফাতের ঘনিষ্ঠ একজন বন্ধু জানান, রিফাত শরীফও মূলত মাদক ব্যবসার সাথে জড়িত ছিল। মাদক নিয়ে দ্বন্দ্বে খুন- এই বিষয়টি নিহতের বাবা সামনে আনতে চাইছেন না বলেই মিন্নিকে দোষারোপ করার পথেই হাঁটছেন।
চার আসামি এখনো গ্রেপ্তার হয়নি- এ নিয়ে কোনো অভিযোগ আছে কিনা জানতে চাইলে দুলাল শরীফ বলেন, ‘পুলিশের প্রতি আমার শতভাগ আস্থা রয়েছে, পুলিশ সঠিক পথেই তদন্ত করছে। আমি আশা করি ঘটনায় জড়িতরা দ্রুতই শাস্তির আওতায় আসবে।’
তদন্ত কোন পথে:
বাদি পক্ষের আইনজীবী অ্যডভোকেট মুজিবুল হক কিসলু মঙ্গলবার এ প্রতিবেদককে জানান, মামলার তদন্ত কর্মকর্তা তাঁকে জানিয়েছেন, ঈদুল আজহার আগেই পুলিশ চার্জশিট দেয়ার চেষ্টা করছে। ১৭ জুলাই আদালতের কাছে কর্মকর্তার দাখিল করা দরখাস্তে উল্লেখ করা হয়, নয়ন বন্ডের সাথে বিবাহবহির্ভূত সম্পর্কের জের ধরেই মিন্নি তাঁর স্বামী রিফাত শরীফকে হত্যার পরিকল্পনা করে।
ব্যক্তিগত কারণে হত্যার পরিকল্পনা করা হলে রিফাত ফরাজী ও রিশান ফরাজীসহ অন্যদের আগ্রাসী ভূমিকার কারণ কি? এ প্রশ্নের উত্তর হিসেবে জেলা পরিষদ চেয়ারম্যানের স্ত্রী খুকি বেগমের সাথে নিহত রিফাত শরিফের বচসার বিষয়টি গণমাধ্যমে আলোচনায় আসে। কিন্ত এ ব্যপারে কাউকে এখানো পর্যন্ত জিজ্ঞাসাবাদ করেনি পুলিশ। এমনকি ঘটনার সময় মুঠোফোনে যিনি ভিডিও করেছিলেন, তাকে তদন্তের স্বার্থে বের করেনি পুলিশ। তবে নয়ন বন্ডের কক্ষ থেকে নারীদের পরিধেয় বস্ত্র, চিরুনি ও প্রসাধনী উদ্ধার করে ফরেনসিক ল্যাবে পাঠানো হয়েছে।
পুলিশের সার্বিক তৎপরতা মিন্নিকে ফাঁসানোর আয়োজন বলে মনে করছেন মিন্নির বাবা মোজাম্মেল হোসেন কিশোর। মিন্নিকে গ্রেপ্তারের পর আদালতে আইনজীবী না পাওয়া, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অপপ্রচার, তিনি ও তার পরিবারের সদস্যদের গোয়েন্দা নজরদারিতে রাখাসহ নানা কর্মকাণ্ডে তিনি আপত্তি তুলেছেন। কিশোর বলেন, ‘হত্যার দায় মিন্নির উপর চাপানোর যত প্রক্রিয়া, সব সম্পন্ন করেছে পুলিশ।’
মিন্নির পক্ষের আইনজীবী মাহবুবুল বারি আসলাম বলেন, ‘মিন্নিকে সাক্ষী থেকে আসামি করার মধ্য দিয়ে এ মামলার মূল সাক্ষী কেউ রইলো না। অর্থাৎ মামলটি পুরোপুরি নির্ভর করছে তদন্ত কর্মকর্তার উপর। তিনি যেসব তথ্য-প্রমাণ উপাস্থাপন করবেন, তার ভিত্তিতেই মামলার বিচারিক কার্যক্রম পরিচালিত হবে।
চার্জশিট ও মামলার তদন্ত বিষয়ে জানতে চাইলে তদন্ত কর্মকর্তা হুমায়ুন কবীর বলেন, ‘তদন্ত প্রতিবেদনেই আপনারা জানতে পারবেন, মামলাটির তদন্তে কোনোকিছুই বাদ দেয়া হয়নি।’
সূত্র- রাইজিংবিডি
Discussion about this post